শিক্ষক প্রশিক্ষণ
নুরানী মোয়াল্লিম প্রশিক্ষণ কোর্স: বিশুদ্ধ কোরআন চর্চা ও নির্মল কর্মস্থানের বিমুগ্ধ পথ
কুরআনের খেদমত এদেশে আলহামদুলিল্লাহ অনেকেই করেছেন এবং এখনও করে যাচ্ছেন। তবে শাইখুল কোরআন আল্লামা কারী বেলায়েত রহ. যতটা বিস্তৃতভাবে, যতটা গোছালো ও পরিকল্পনা মতো এই খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন এর নজির খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এই দেশের প্রতিটি প্রান্তে তাঁর খেদমতের পরিধি বিস্তৃত। পবিত্র কুরআনের বিশুদ্ধ তেলাওয়াত এবং প্রয়োজনীয় দীনি শিক্ষার প্রসারে গোটা জীবন তিনি ওয়াকফ করে দিয়েছিলেন। তাঁর নিয়তে ছিল পরিশুদ্ধতা, দৃষ্টিভঙ্গি ছিল দিগন্ত বিস্তৃত, সাধনা ছিল নিরলস আর দীনের দরদ ছিল অভূতপূর্ব।
একটা সময় ছিল এদেশের শিশুদের বিশুদ্ধ কুরআন শিক্ষার কোনো কারিকুলাম বা পদ্ধতি ছিল না। প্রাচীন যুগের কায়েদায়ে বোগদাদি চলে আসছিল শত শত বছর ধরে। আমাদের মকতবগুলোতে গদবাঁধা এই কায়েদাই পড়ানো হতো। কিন্তু এর দ্বারা কুরআন বিশুদ্ধভাবে তেলাওয়াত করতে পারত খুব কম শিশুই। বিশেষ করে পরবর্তী সময়ে যাদের মাদরাসায় পড়াশোনার সুযোগ হতো না, শুধুই মক্তবে কায়েদা পড়ত তাদের তেলাওয়াতে প্রচুর সমস্যা থাকত। সম্ভবত এদেশে শাইখুল কোরআন আল্লামা কারী বেলায়েত রহ.-ই সর্বমহলে ব্যাপক স্বীকৃত পদ্ধতির আবিষ্কার করেন। তাঁর সমকালে এই চেষ্টাটা হয়ত আরও কেউ কেউ করেছেন কিন্তু তিনি অধিক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছেন। বিশেষ করে দুই শীর্ষ মুরব্বি হজরত শামছুল হক ফরিদপুরী ও হাফেজ্জী হুজুর রহ.-এর তত্ত্বাবধানে শুরু হওয়ায় তাঁর আবিষ্কৃত পদ্ধতিটি আলেম-উলামার কাছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পায়। মূলত কুরআনের বিশুদ্ধ শিক্ষা যারা দেবেন সেই শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলার মাধ্যমে এই পদ্ধতি অভূতপূর্ব সফলতা অর্জন করে। কারণ শিক্ষার্থীদের আগে শিক্ষকের প্রশিক্ষণ বেশি জরুরি সেটা কারী বেলায়েত রহ. অনুধাবন করেছিলেন। এজন্য তিনি দেশের নানা প্রান্তে শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। তাঁর হাতে গড়া শিক্ষকেরাই কুরআনের আলোয় আলোকিত করে বাংলার বিস্তৃত জমিন। সম্ভবত দেশের এমন কোনো এলাকা পাওয়া যাবে না যেখানে তাঁর সরাসরি ছাত্র কিংবা তাঁর আবিষ্কৃত পদ্ধতির প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কেউ নেই। এভাবে তিনি ছয় দশকের বেশি সময় এদেশে কুরআনি শিক্ষার এক ‘নীরব বিপ্লব’ সাধন করে গেছেন।
বর্তমানে শিশু শ্রেণি থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত চার বছরের নূরানী কোর্স চালু রয়েছে। মাওলানা কারী বেলায়েত হুসাইন রহ. প্রণীত ‘নূরানী পদ্ধতিতে কুরআন শিক্ষা’ বইটিই এর মূল সিলেবাস। বইটি চার ভাগ করে সব শ্রেণিতেই এটি পড়ানো হয়। সিলেবাসে আরও রয়েছে- নূরানী বাংলা শিক্ষা, নূরানী অংক শিক্ষা, নূরানী ইংরেজি শিক্ষা, নূরানী আরবি ভাষা শিক্ষা, নূরানী সাধারণ জ্ঞান, নূরানী দ্বীন শিক্ষা, নূরানী ফাজায়েলে সুরা। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলা এমনকি গ্রামে-গঞ্জে এই সিলেবাসের নূরানী মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং দিন দিন এর পরিমাণ বেড়েই চলেছে। দেশের নামকরা কওমি মাদরাসাগুলোতেও কারী বেলায়েত হুসাইনের নূরানী চালু হয়েছে। সেজন্য সময়ে সময়ে নূরানীর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক চেয়ে কেন্দ্রে আবেদনও জানানো হয়। বহির্বিশ্বেও কোনো কোনো দেশে প্রবাসী বাঙালি শিক্ষকদের মাধ্যমে বাঙালি শিশুদের জন্য এমন নূরানী মাদরাসা চালু হওয়ার খবর পাওয়া যায়।
শাইখুল কুরআন রহ. এর সবচেয়ে বেশি প্রশংসনীয় দিক আমার কাছে যেটা মনে হলো- তিনি কুরআনের মেহনত নিজে করতেন এবং অপরের জন্য সে মেহনতে শরিক হওয়ার পথ সুগম করে দিতেন। তার সে চিন্তা থেকেই তিনি শুরু করেন নুরানী মোয়াল্লিম ট্রেনিং কোর্স। বাংলাদেশের ইতিহাসে হয়তো তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি একক প্রচেষ্টায় নুরানী মোয়াল্লিম ট্রেনিং কোর্সের মাধ্যমে বিশাল এক জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন। আর এর ফলে শুধু কওমি মাদরাসা শিক্ষিতরা নন, জেনারেল শিক্ষিতদেরও বড় একটি অংশ নিজেদের জন্য এমন একটি কর্মসংস্থান খুঁজে পান; যার সঙ্গে যুক্ত হলে দুনিয়া ও আখেরাত উভয়ই উজ্জ্বল ও সজীব।
শাইখুল কোরআন রহ. ছিলেন একজন দরদী মানুষ। উম্মতের ব্যথায় কোনরূপ উপায়-উপকরণহীন পথে নেমে এসেছেন আবেগ দায়িত্বানুভূতি ও ভালোবাসার টানে। শপথ একটাই; এদেশের শতভাগ মুসলমানকে কোরআনের বাণী শেখাবো। ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় নূরানী তা’লীমুল কুরআন বোর্ড। এই বোর্ডের অধীনে এবং নূরানী সিলেবাসে স্বাধীন পরিচালনায় তখন ১৯ হাজার নূরানী মাদরাসা বিলাচ্ছে সেই নূর। এই বোর্ডের আটটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষিত এক লাখ ১৯ হাজার শিক্ষক কাজ করছেন দেশময়। এই বোর্ডের একটি জরিপে দেখা গেছে- এ পর্যন্ত ৯০ লাখ শিক্ষার্থী এই সিলেবাসে পড়াশোনা করে পবিত্র কোরআন জরুরি দীন ও আধুনিক প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেছেন।